সমকাল প্রতিবেদক | সমকাল ২২ মে, ২০২১

দেশের পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী চাশিল্পে কাজ করছেন। দীর্ঘদিনেও তাদের ভাগ্যের তেমন পরিবর্তন হয়নি। এই শ্রমিক পরিবারগুলোর খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার ক্ষেত্রে আরও সহযোগিতা বাড়ানো জরুরি। শ্রমিকের ভাগ্যের পরিবর্তনে চাশিল্পের উন্নয়ন প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ জন্য এই শিল্পের উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

গতকাল শুক্রবার আন্তর্জাতিক চা দিবসে ‘চা শ্রমিকের সুরক্ষা :চ্যালেঞ্জ ও জবাবদিহিতা’ শীর্ষক এক অনলাইন সংলাপে বিশেষজ্ঞরা এসব পরামর্শ দেন। সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (এসইএইচডি) আয়োজিত এ সংলাপে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, জলাবদ্ধ, আবদ্ধ এলাকার পরিবেশ ভালো হয় না। চা শ্রমিকদের সেখান থেকে আস্তে আস্তে মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। মূলধারার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা বলেন, চা শ্রমিকদের প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষার সুযোগ দিতে হবে। তাদের মধ্যে যাতে সম্ভাবনার দৃষ্টান্ত তৈরি হয় এবং আকাক্সক্ষা তৈরি হয়, সেজন্য বাতায়ন খুলে দিতে হবে। তিনি বলেন, চাশিল্পের লাভ-ক্ষতির ওপর শ্রমিকের সুযোগ-সুবিধা নির্ভর করবে। তাই এ শিল্পের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। সব জায়গায় দারিদ্র্য আছে, কিন্তু নানা কারণে চা শ্রমিকরা একটি বিশেষ গোষ্ঠী হিসেবে একটি জায়গায় আবদ্ধ হয়ে আছে। তাদের মধ্যে আসল দরিদ্র কতজন, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। বিবিএসের প্রচলিত পদ্ধতি দিয়ে, একটি বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান দিয়ে এদের দারিদ্র্য ও অতিদারিদ্র্য হার জরিপ করা প্রয়োজন। কারণ, সঠিক পরিসংখ্যান ছাড়া সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব নয়।

অনুষ্ঠানের সভাপতি গবেষণা সংস্থা পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, চা শ্রমিকরা এ দেশের নাগরিক। তারাও মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন। প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নয়নে রাষ্ট্রের দায়িত্ব অনেক বেশি। তাদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা বাড়ানো দরকার। চা শ্রমিকের প্রকৃত পরিসংখ্যান দরকার। যাতে সুষ্ঠু কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এ খাতের উন্নয়ন করা সম্ভব হয়।

সংলাপে বিশেষ অতিথি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব কে. এম. আবদুস সালাম বলেন, সরকার চাশিল্পের জন্য উন্নয়ন পরিকল্পনা করছে। পাঁচ বছর মেয়াদি এ পরিকল্পনায় শ্রমিকদের কল্যাণে করণীয় নির্ধারণ করা হবে। করোনা পরিস্থিতিতে তারা সামাজিক সুরক্ষা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বেশি গুরুত্ব পাবে।

বাংলাদেশ চা সমিতির চেয়ারম্যান শাহ আলম বলেন, চা উৎপাদনে কেজিতে ২০০ টাকা খরচ হলেও বিক্রির নিশ্চিয়তা নেই। এ ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রয়োজন। কোম্পানি টিকে থাকলে শ্রমিকের সুবিধা নিশ্চিত হবে। তিনি জানান, নিলাম থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়ে শ্রমিক কল্যাণ তহবিল গঠন করার প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হয়েছে। এ প্রস্তাব অনুমোদন হলে শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়বে।

নিজেরা করি ও বাংলাদেশের সমন্বয়ক খুশী কবির বলেন, শ্রমিকরা বৈষম্যের শিকার। তবে এখন চা স্থানীয়ভাবে বিক্রি হওয়ায় কমপ্লায়েন্স অনুসরণ করা হচ্ছে না।
শাহ্জালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় ফিরে আসার বিষয়টি শিক্ষার ওপর নির্ভর করছে। এ ক্ষেত্রে সংশ্নিষ্ট এলাকায় সরকার স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে পারে। শাহ্জালাল বিশ্ববিদ্যালয় চা শ্রমিকের সন্তানদের জন্য কোটা ও বৃত্তি চালু করেছে।

মূল প্রবন্ধে এসইএইচডির পরিচালক ফিলিপ গাইন বলেন, দেশে দুই লাখ ৮৫ হাজার ১৩৯ একর জমিতে ১৫৮টি চা বাগান রয়েছে। এতে এক লাখ ৪০ হাজার ১৮৪ জন শ্রমিক বর্তমানে কাজ করেন। চা বাগানে যারা কাজ করেন, তাদের মাসিক আয় ছয় হাজার টাকা, দৈনিক আয় ২০০ টাকা। তবে এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে ফিনলে চায়ের চিফ অপারেটিং অফিসার ও বাংলাদেশ চা সংসদের শ্রমিক ওয়েলফেয়ার কমিটির আহ্বায়ক তাহসিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, প্রতি মাসে প্রত্যেক শ্রমিকের মজুরি বাবদ নগদ টাকাসহ ১২ হাজার টাকা খরচ হয়। এ হিসাবে প্রতিদিন ৪০৩ টাকা পান শ্রমিকরা। এর বাইরে তাদের হাসপাতাল ও ওষুধ সেবা দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরি অভিযোগ করেন, চুক্তি হলেও তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় শ্রমিকরা বঞ্চিত হচ্ছেন। বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র চট্টগ্রামের সভাপতি তপন দত্ত বলেন, চা শ্রমিকরা আইনি বৈষম্যের শিকার। আইনে থাকলেও কোম্পানিগুলোর মুনাফার অংশ পান না শ্রমিকরা।
মৌলভীবাজারের জুরি ভেলী চা বাগানের শ্রমিক নেতা বাউরি বলেন, স্বাধীন দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি করতে হলে চা শ্রমিকের জীবনমান পরিবর্তন করতে হবে।